ও লো সই
-বর্ণালী জানা
ফোনটা আজও বেজে গেল। কেউ ধরলো না। এই নিয়ে তিনদিন। পর্ণার সঙ্গে আলাপের পনেরোটা বছরে এমনটা কখনও হয়নি। হওয়ার কথাও তো ছিল না। তার সঙ্গে ফোনে বকবক করে সারাদিনের রুটিন আদ্যোপান্ত না বললে পর্ণার তো ভাতই হজম হয় না। ওর ফোনের জ্বালায় অদিতি মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়েছে। কথা তো একই কী রান্না হল, মেয়ে স্কুলে গিয়ে কী করলো, সুতীর্থের অফিসে কী পলিটিক্স হল…ওই থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়। পারেও বটে মেয়েটা। বকবক করে একেবারে মাথার পোকা নড়িয়ে দেয়। ঠিক আছে তো ওরা! সুতীর্থর কিছু হল না তো? পর্ণাই বলছিল, আজকাল সুতীর্থের শরীরটা ভালো থাকে না। অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে ভীষণ হাঁফিয়ে যায়। বয়সটা তো বাড়ছে। ফুটবল ম্যাচে, ডিবেটের মঞ্চে মফস্বলের মেয়েদের বুকে ঝড় তোলা সুতীর্থ এখন বিগত যৌবন প্রৌঢ়। অদিতির মানতে কষ্ট হলেও এটাই সত্যি। সেই ডাকাবুকো, হ্যান্ডসাম, ব্রিলিয়ান্ট, সবার বিপদে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা আজ নেতাই ছাপোষা সংসারী। শুধু মেয়ে আর বউকে নিয়ে জগৎ। পর্ণা বলছিল শুধু বাড়ি আর অফিস। তার বাইরে সুতীর্থ কোথাও যায় না। কারো সঙ্গে মেশে না। কোনো বন্ধু-বান্ধবও নেই। আড্ডা নেই। আগেকার মতো কথায় কথায় অট্টহাসি নেই। লেগপুলিং নেই। শুধু মেয়েকে পড়ানো। তারপর খেয়েদেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুম। এমন নিপাট সংসারী, গোবেচারা সুতীর্থকে অদিতি কখনোই ভালোবাসতে পারত না।
কিন্তু পর্ণার হলটা কী। ফোন বেজে যাচ্ছে দেখে অদিতি ভয়েস মেসেজও দিয়ে রেখেছে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তবে কি অদিতিই চিনতে ভুল করেছিল? এতদিন বন্ধুত্বের ভান করে অদিতির মনের কথা সব বের করে নিতে চেয়েছিল? কিন্তু সুতীর্থের সঙ্গে বিয়ের পর মেয়েটা তো যেচে এসেই আলাপ করেছিল। সেটাও কি ভড়ং ছিল? অদিতি খবর পেয়েছিল সুতীর্থ বিয়ে করেছে। একেবারে মায়ের বেছে দেওয়া ঘরোয়া, লজ্জাশীলা, রন্ধনপটিয়সি মেয়েকে। ছেলেকে যাতে কোনো কষ্টই করতে না হয়। বিদেশ বিভুঁই-তে ছেলেকে যাতে এক কাপ চা’ও হাত পুড়িয়ে না করতে হয়। অদিতির মতো বেহায়া, সারা শহরে সাইকেল নিয়ে চক্কর দিয়ে বেড়ানো, রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে হ্যা হ্যা করে হেসে কথা বলা মেয়েকে সুতীর্থর মায়ের একেবারেই নাপসন্দ। তারপর যে মেয়ে চাকরি করতে চায় তার সংসার কখনও সুখের হয় না। অনেকদিন সুতীর্থের খবর না পেয়ে নিজেই একদিন ওদের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। তখন সুতীর্থর মায়ের অনেক বাঁকা কথাও শুনেছে। যাই হোক সেসব অদিতি আজ মনে রাখতে চায় না। তার সঙ্গে দেখা করে পর্ণা অনেক কথা বলেছিল- ‘অদিতিদি, তোমার বন্ধুর কাছ থেকে তোমার কথা অনেক শুনেছি। সেই থেকে তোমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে। আজ তোমাকে দেখে চক্ষু সার্থক করলাম’। অদিতির একদম সহ্য হচ্ছিল না মেয়েটাকে। যত্তসব ন্যাকামি। বরের বান্ধবীকে দেখার জন্য নাকি তর সইছিল না! দেখে সাদাসিদে গ্রামের মেয়ে হলে কী হবে পেটে পেটে এত বুদ্ধি! একেবারে পাক্কা ডিপ্লোম্যাট! হঠাৎ করে একটা মেয়ে কোথা থেকে উড়ে এসে সুতীর্থর জীবনে জুড়ে বসলো—এটা কিছুতেই অদিতি মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তাই মেয়েটাকেও সেদিন বেশি কথা বলার সুযোগ দেয়নি। হুঁ হাঁ করে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল। তারপর মেয়েটাকে আর মনেও রাখেনি। তার অনেক ব্যস্ততা। চাকরি, লেখালেখি, এনজিও-র কাজ—সারাদিনে অদিতি কোনো সময় নেই। সে নিজেও এখন ব্যস্ত থাকতে চায়। সুতীর্থর কথা মনেও রাখতে চায় না। এত বড় শহরে একা একা সব কাজ সামলানো চাট্টখানি কথা নয়।
আবার একদিন পর্ণার ফোন… ‘দিদি, একবারও ফোন করলে না। তাই নিজে থেকেই করলাম। সুতীর্থ এখন পুণেতে ট্রান্সফার নিয়েছে। এটা আমার নতুন নম্বর। ফোন কোরো কিন্তু’।
মনটা তেতো হয়ে গেল অদিতির। সুতীর্থ পুণে চলে গেল সেকথা সে একবারও নিজে ফোন করে জানাতে পারলো না। সুতীর্থ যখন নিজেই এড়িয়ে যেতে যায়, তাহলে অদিতিরই বা যেচেপড়ে খবর নেওয়ার কী দরকার!
কিন্তু মেয়েটা তো বড্ড নাছোড়। মাঝে মাঝেই ফোন। কথার আর শেষ নেই ওর। ফোন করে এটা সেটা বকেই যায়। নিজের সংসারের কথা, বাবা-মায়ের কথা, ছোটবেলার কথা। যেন অদিতিকে বলে একটু হালকা হতে চায়’।
‘জানো দিদি, তোমার মতো লেখাপড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দাদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার অনেক খরচ। প্রাইভেট কলেজ। আমার দিকে কেউ নজরই দেয়নি। আগাছার মতো বেড়ে উঠেছি। তারপর কলেজ পাশ করতে না করতেই বাবা ঠেলে দিল বিয়ের পিঁড়িতে’।
অদিতির একটু মায়াও হল। কথা শুনে মনে হয় মেয়েটার মনটা বড্ড খাঁটি। অদিতি ওকে খামোখাই ভুল বুঝেছিল। আর তাছাড়া পর্ণা যদি তার সঙ্গে মনের দুটো কথা বলতেই চায় তাতে ক্ষতিটাই বা কী? সুতীর্থর বউ হিসাবে নয়, ব্যক্তি পর্ণার সঙ্গে তো তার ভাব হতেই পারে। ব্যস সেই থেকেই শুরু। প্রতিদিন রাতে চলে তাদের ফোনপর্ব। রাত বারোটা-সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। সারাদিন কী হল, না হল, কী রান্না হল, সুতীর্থ কখন অফিস গেল, কখন এল সব বৃত্তান্ত পর্ণার বলা চাই।
একদিন তো অদিতি মজা করে বলেই ফেলল… ‘কী যে কাণ্ড করিস না তুই। এতো রাত অবধি আমার সঙ্গে কথা বলছিস! বর তো ওদিকে বিছানার ছটফট করছে’!
‘দূর সে এখন ঘুমেই কাদা। বিছানায় পড়লেই মোষের মতো ঘুম। আর তাছাড়া, তোমার সঙ্গে কথা বললে ও কিছু মনে করে না। বরং খুশিই হয়। মাঝে মাঝে ফোনটা স্পিকারেও দিয়ে রাখি, ও যাতে তোমার গলাটা অন্তত শুনতে পায়’।
অদিতির বুকের ভেতরটা একটু চিনচিন করেছে। কে বলেছে ওকে স্পিকারে ফোন দিতে! অদিতি কি ওর দাক্ষিণ্য চেয়েছে নাকি। অদিতি চৌধুরি আজ সফল মানুষ। পৃথিবীতে কারো দয়া ওর দরকার নেই। সেটা ছাড়াও সে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে। সাফল্যের একটা আলাদা স্বাদ আছে। সেটা মনের সব ক্ষত সারিয়ে দেয়। মেয়েটাকে কাটা কাটা ভাবে একটু কথা শুনিয়ে দিল অদিতি… ‘দেখ, আমি কিন্তু ব্যক্তি পর্ণার সঙ্গে কথা বলি। পি ডব্লিউ ডি-র এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিয়ার সুতীর্থ চ্যাটার্জীর বউ হিসাবে নয়। এটা যদি মনে রাখতে না পারিস তাহলে ফোন করিস না আমায়’।
মেয়েটা একটু অদ্ভূতই বটে। কোনো কথাই তার গায়ে লাগে না পরের দিনই আবার দিব্যি ফোন। মাঝে মাঝেই বলে ও নিজে কিছু একটা করবে। সারাদিন ঘরে বসে বরের পথ চেয়ে বসে থাকতে থাকতে সে নাকি হাঁপিয়ে উঠছে। অদিতি ওকে একটা বুটিক করার পরামর্শ দেয়। পর্ণা ওটা খুব ভালো করবে।
কিন্তু সেসব আরো হল না। তার আগেই পর্ণা মা হয়ে বসলো। এত প্ল্যান সব শিকেয় উঠলো। অদিতি একটু বিরক্তই হল… ‘এইজন্যই এইসব মেয়ের দ্বারা কিছু হয় না’। তবে পর্ণার ফোনেই আবার সব রাগ জল। পর্ণার দাবি ওর মেয়ের নাম নাকি অদিতিকেই ঠিক করে দিতে হবে। না, ও কোনো কথা শুনবে না।
‘না তা কী করে হয়। মেয়ের দাদু, ঠাকুমা আছে। তাদের মতামত তো নিতে হবে। একমাত্র ছেলের মেয়ে বলে কথা’।
‘সে যে যা বলে বলুক। তোমার নামটাই ফাইনাল’।
এ অনুরোধ আর অদিতি ফেরায় কী করে! অনুরোধ নয়, বরং বলা যেতে পারে দাবি। যাইহোক, সুন্দর, আনকমন একটা নাম ঠিক করে দেয় অদিতি। পর্ণা আনন্দে আত্মহারা। এমন সুন্দর নাম নাকি সে আগে কখনও শোনেনি’।
অদিতি এখন খুব ব্যস্ত। জীবন অনেক বদলে গেছে তার। প্রোমোশনের পরে কাজের দায়িত্ব বেড়েছে। এখন সে আর শামুকের মতো গুটিয়ে থাকে না। নতুন দু-একজন বন্ধুও হয়েছে। কিন্তু যেটা বদলায়নি সেটা হল রাত দশটায় পর্ণার ফোন। পর্ণার মেয়ের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্নটা কাজের বাহানা দিয়ে অদিতি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেল। সুতীর্থদের বাড়িতে সে আর পা-রাখবে না কোনোদিন। নিজের অপমান যারা ভুলে যায় তাদের ভগবানও ক্ষমা করে না। সে না যাওয়াতে পর্ণা একটু কষ্ট পেয়েছিল বটে। কিন্তু অদিতির মান-সম্মান বোধ অতি প্রখর। সেখানে কোনো কমপ্রোমাইজ নেই। কিন্তু সেই কমপ্রোমাইজটা করতেই হয়েছিল পর্ণার মেয়ের পাঁচ বছরের জন্মদিনে। পর্ণার ভালোবাসার কাছে হার মানতে হয়েছিল অদিতিকে। মেয়ের জন্মদিনে সসম্মানে পর্ণা ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। অদিতিকে যেভাবে আপ্যায়ন করেছিল তাতে সবার থোতা মুখ ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। অপমান আর ভালোবাসা—বোধহয় একই মুদ্রার দুটো পিঠ। হবে হয়তো। মেয়েটাকে যত দেখে অদিতি ততই অবাক হয়। মেয়েটা বোধহয় অন্য গ্রহের মানুষ। চেনা ছকে ওকে ফেলা যায় না। চেনা সমীকরণে ওকে মেলানো যায় না।
পনেরোটা বছর বড় দীর্ঘ সময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্ণা আর অদিতির সম্পর্কের বাঁধন আরো শক্ত হয়েছে। পর্ণা এখন ওর নতুন বুটিক নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন আর প্রতিদিন কথা হয় না ঠিকই, কিন্তু অদিতি জানে সম্পর্কের আলগা সুতোগুলোর ঠাস বুনোট হয়ে গেলে বার বার আর রিঅ্যাসিওরেন্সের দরকার পড়ে না।
কিন্তু এবার অদিতি একটু ধন্দেই পড়েছে। তিনদিন ফোন বেজে যাচ্ছে। সুতীর্থকে ফোন করে অদিতি খবর নিতেই পারে। কিন্তু অদিতি নিজেকে অত ছোট করতে পারবে না। উপযাচক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখায় তার বিশ্বাস নেই। সে অপেক্ষা করতে রাজি। কিন্তু পর্ণার মন যদি বদলে গিয়ে থাকে! সে যদি এখন অদিতিকে নিজের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেয়! ওসব মেয়েদের খুব চেনা আছে অদিতির। যতই উদার বলে নিজেদের দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন, সেই পাতি মিডল ক্লাশ মেন্টালিটির বাইরে এরা বেরোতেই পারে না। যাকগে অদিতি ওসব নিয়ে আর ভাববে না। তার এখন অনেক কাজ। ওসব ফালতু সেন্টিমেন্টের কোনো দাম নেই তার কাছে। তবু মনের মধ্যে খচখচে কাঁটাটা রয়েই যায়।
একমাস পরে আবার মহারানির ফোনাঘাত। রাত একটায়। অদিতি চোখ ঘুমে জড়ানো। কিন্তু ঐপ্রান্তে আবার কিচিরমিচির। এটাই তো মুশকিল অদিতির। বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না। তাই পর্ণার গলা শুনে আবার তার রাগ জল।
‘কী ব্যাপারটা কী শুনি?’
‘আরে রাগ কোরো না প্লিজ। এই বুটিকের কাজ, সংসারের হাজার ঝামেলা ওয়াশিং মেশিন খারাপ, ফ্রিজ বেগড়বাই, মেয়ের স্কুল, বরের অফিস। আর সামলাতে পারি না গো। প্রতিদিনই করবো করবো ভাবি, কিন্তু করা হয়ে ওঠে না’।
‘আচ্ছা ঠিক আছে এবারের মতো মাফ। এরপর যদি এমন আর করিস…
‘সরি সরি, আর ভুল হবে না ম্যাডাম’।
‘আমি ভাবলাম বরের সঙ্গে খুব ঝামেলা করেছিস’।
‘না না আগে করতাম। কিন্তু এখন আর একটুও করি না। আগে যা ভালোবাসতাম এখন তার দ্বিগুণ বাসি’।
‘বাঃ বেশ বেশ’।
‘কারণটা জিগ্যেস করলে না তো?’
‘কেন করবো? তোদের ব্যক্তিগত ব্যাপার’।
‘না তোমাকে শুনতেই হবে’।
‘বলে ফেল’।
‘কারণ আমাকে যে ডবল ভালোবাসার বোঝা বইতে হয়’।
‘মানে?’
‘হ্যাঁ গো, মানে তোমার আর আমার। একবার আমার চোখ দিয়ে দেখে ভালোবাসি। আরেক বার তোমার চোখ দিয়ে। কী ডবল হলো না?’